টিপু সুলতানের আসল নাম সুলতান ফতেহ আলী সাহেব টিপু। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৭৫০ সালের ২০ নভেম্বর, দক্ষিণ ভারতের দেবনহল্লি নামক স্থানে (বর্তমান কর্ণাটক রাজ্যে)। তাঁর পিতা ছিলেন হায়দার আলী, যিনি একসময় মাইসোর রাজ্যের সেনাপতি থেকে ধীরে ধীরে মাইসোরের শাসক হন। মাতা ছিলেন ফাতিমা ফকরুন্নিসা। ছোটবেলা থেকেই টিপু অশ্বারোহণ, তরবারি চালনা, তীর-ধনুক ও সামরিক বিদ্যায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি তিনি ফার্সি, আরবি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।
১৭৮২ সালে পিতা হায়দার আলীর মৃত্যুর পর টিপু সুলতান মাইসোরের সিংহাসনে বসেন। তিনি মাইসোর রাজ্যকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেন। সামরিক কৃতিত্ব ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম টিপু সুলতান তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে লড়াই করে। মোট চারটি অ্যাংলো-মাইসোর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।
প্রথম যুদ্ধ (১৭৬৭–১৭৬৯): টিপু তখনও রাজা হননি, তবে পিতা হায়দার আলীর সাথে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশরা শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হয়।
দ্বিতীয় যুদ্ধ (১৭৮০–১৭৮৪): হায়দার আলীর মৃত্যুর পর টিপু নেতৃত্ব নেন। তিনি ইংরেজদের একাধিকবার পরাজিত করেন। মঙ্গলোর চুক্তি (১৭৮৪) অনুযায়ী উভয়পক্ষ সমঝোতায় পৌঁছায়।
তৃতীয় যুদ্ধ (১৭৯০–১৭৯২): ব্রিটিশরা মারাঠা ও হায়দরাবাদকে নিয়ে জোটবদ্ধ হয়। টিপু শেষ পর্যন্ত শ্রীরঙ্গপট্টনম চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। এতে তিনি অর্ধেক ভূখণ্ড হারান, বিপুল অর্থ ক্ষতিপূরণ দেন এবং নিজের দুই ছেলেকে ইংরেজদের কাছে বন্ধক রাখতে হয়।
চতুর্থ যুদ্ধ (১৭৯৯): টিপু ফ্রান্সের সাথে মিত্রতা গড়ে তোলেন। ইংরেজরা আশঙ্কা করে তাঁকে আক্রমণ করে। শ্রীরঙ্গপট্টনম দুর্গে ভয়ংকর যুদ্ধ হয়। ৪ মে ১৭৯৯ সালে টিপু সুলতান বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন। বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অবদান টিপু সুলতান ছিলেন প্রথম ভারতীয় শাসক যিনি রকেট অস্ত্র (Mysorean rockets) ব্যবহার করেন। তাঁর আবিষ্কৃত রকেট প্রযুক্তি পরে ব্রিটিশরা ইউরোপে নিয়ে যায়, যা আধুনিক রকেটবিজ্ঞানের সূচনা করে।
প্রশাসন ও সংস্কার: অর্থনীতি ও কৃষি: রেশম চাষ ও বাণিজ্যের প্রসার ঘটান। নতুন মুদ্রা চালু করেন। কৃষকদের উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নেন। ফ্রান্স, অটোমান সাম্রাজ্য, আফগানিস্তান প্রভৃতির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ইংরেজ বিরোধী আন্তর্জাতিক জোট গড়ার চেষ্টা করেন। টিপু সুলতান একজন ধর্মপরায়ণ মুসলমান ছিলেন, তবে তিনি ন্যায়পরায়ণ ও প্রজাপ্রেমী শাসক হিসেবে পরিচিত। তিনি মসজিদ নির্মাণের পাশাপাশি হিন্দু মন্দিরের প্রতিও সাহায্য করতেন। চরিত্র ও উপাধি তাঁর সাহসিকতার কারণে তাঁকে বলা হয় “মাইসোরের বাঘ” (Tiger of Mysore)।
তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি: “সিংহ হয়ে একদিন বেঁচে থাকা ভালো, শেয়াল হয়ে একশ বছর বেঁচে থাকার চেয়ে।”
মৃত্যু: ৪ মে ১৭৯৯ সালে চতুর্থ অ্যাংলো-মাইসোর যুদ্ধে শ্রীরঙ্গপট্টনম দুর্গে শহীদ হন। মৃত্যুর সময়ও তিনি লড়াই করছিলেন, আত্মসমর্পণ করেননি। উত্তরাধিকার টিপু সুলতানকে ভারতের স্বাধীনতার প্রথম সারির সংগ্রামী হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি কেবল যোদ্ধাই ছিলেন না, বরং বিজ্ঞানমনস্ক, দূরদর্শী শাসক ও দেশপ্রেমিকও ছিলেন। তাঁর আবিষ্কার, প্রশাসনিক সংস্কার এবং ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম তাঁকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে।
আতা মোহাম্মদ উবায়েদ (ইতিহাস, ঐতিয্য ও ভ্রমন বিষয়ক লেখক)