সত্যকে উদঘাটন করার জন্য সাংবাদিকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে, সমাজের সামনে অন্ধকার দূর করে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করে। সাংবাদিকতা একটি মহৎ পেশা। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন নিউজপোর্টাল কিংবা রেডিও—সব জায়গাতেই সাংবাদিকরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন মানুষের জানার অধিকার পূরণের জন্য। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো,এই সাংবাদিকরাই যখন মানুষের দুঃখ–কষ্ট তুলে ধরেন, তখন তাদের নিজেদের দুঃখ–কষ্ট গুলো অদৃশ্য থেকে যায়।
নিয়মিত সংবাদপত্রে শিরোনাম দেখেন সাধারণ মানুষ, টেলিভিশনে সংবাদ শোনেন বা অনলাইনে কোনো রিপোর্ট পড়েন কিন্তু এর পেছনে থাকা শ্রম, সংগ্রাম, ঝুঁকি ও মানসিক চাপ সম্পর্কে ধারণা রাখেন এমন মানুষের সংখ্যা খুবই হাতে গোনা। প্রতিনিয়ত মফস্বল সাংবাদিকদের এমন সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় যা খুবই বেদনাদায়ক।অনেক ক্ষেত্রে জীবন–মৃত্যুর সঙ্গেও লড়াই করতে হয় সাংবাদিকদের। তিন দিক থেকে চাপে থাকতে হয় একজন সাংবাদিককে প্রথমত সত্যকে প্রকাশ করার চেষ্টা, দ্বিতীয়ত সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনৈতিক প্রভাব মোকাবিলা করা ও তৃতীয়ত অর্থনৈতিক সংকট ও পারিবারিক চাপের মতো বাস্তবতা।
সাংবাদিকদের এই বেদনাদায়ক কষ্টগুলো সাধারণ মানুষের চোখে ধরাই পড়ে না। কোনো দুর্ঘটনার ঘটনার পরপরই সাংবাদিককে সেখানে যেতে হয়, ছবি তুলতে হয়, তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। তখন তিনি নিজের মানবিক অনুভূতিগুলো চাপা দিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন। আবার রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও সাংবাদিকরা অন্যদের মতো ঘরে নিরাপদে বসে থাকতে পারেন না। তাদের যেতে হয় ঘটনাস্থলে, যেখানে অন্যরা যেতে সাহস পান না।
সহজেই বলা যায় সাংবাদিকদের নিঃশব্দ সংগ্রামী জীবনের বেদনা, অস্বস্তি ও কষ্ট অদৃশ্যই থেকে যায়।
সাংবাদিকতার ইতিহাস ও সামাজিক ভূমিকা: সাংবাদিকতা একটি পেশা যার মাধ্যমে একটি দেশের তথা সমাজের রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সংস্কৃতির সংবাদ প্রচারের বার্তা। ধীরে ধীরে এটি প্রিন্ট মিডিয়া, রেডিও, টেলিভিশন এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে আধুনিক সাংবাদিকতায় রূপ নিয়েছে।
সত্য প্রকাশ করা এবং জনগণকে তথ্য সরবরাহ করাই সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য বা কাজ। সমাজে একজন সাংবাদিক শুধুমাত্র খবর প্রদান করেন না, তিনি সমাজের চোখ, কান হিসেবে কাজ করেন। এই পেশায় রয়েছে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ।
সাংবাদিকতার সামাজিক গুরুত্ব অগণিত। একটি সমাজে গণমাধ্যম থাকলে মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা হয়। সরকারি নীতি, অর্থনৈতিক পরিবর্তন, আইন ও সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে মানুষ সচেতন হয়। সাংবাদিকরা কখনো কখনো দুর্নীতি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সমাজের নেতৃত্বও দেন। তারা খবরের মাধ্যমে অন্যদের সচেতন করে, সামাজিক পরিবর্তন আনে।
তবে, এই সামাজিক দায়িত্বের সাথে যুক্ত আছে ব্যক্তিগত দুঃখ ও চাপ, যা সহজে চোখে পড়ে না। কারণ, সাংবাদিকরা প্রায়শই একাই নিরপেক্ষ থাকতে চেষ্টা করেন, নিজেদের অনুভূতি বা ভয় প্রকাশ করেন না। তারা জানেন সংবাদ প্রকাশের সময় তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা বা কষ্ট যেন খবরের স্বচ্ছতা নষ্ট না করে।
ফলে সাংবাদিকতার ইতিহাস শুধু পেশাগত গৌরব নয়, এটি লুকানো দুঃখ, সংগ্রাম এবং নিঃশব্দ ত্যাগের ইতিহাসও। আধুনিক যুগে সাংবাদিকরা যেমন প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত সংবাদ পৌঁছে দেন, তেমনি তারা নীরবভাবে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি ও মানসিক চাপ বহন করেন।
সাংবাদিকদের দৈনন্দিন সংগ্রাম:সাংবাদিকদের কাজ কখনোই সহজ নয়। প্রতিদিন তাদের মুখোমুখি হতে হয় নতুন-নতুন চ্যালেঞ্জের—যা শুধু পেশাগত নয়, মানসিক ও শারীরিক দিক থেকেও কঠিন। সংবাদ সংগ্রহ, সত্য যাচাই, রিপোর্ট লেখা এবং তা জনসমুক্ষে উপস্থাপন করতে এসবের মধ্যে লুকানো থাকে অসংখ্য ছোট-বড় কষ্ট।
সময় ও চাপের অসীমতা: সাংবাদিকদের জীবনে সময় খুব মূল্যবান, কিন্তু কখনও তা নিজের জন্য থাকে না। তারা সবসময় ‘সংবাদ’ বা ‘ঘটনা’ অনুসরণ করে চলেন। কোনো বড় দুর্ঘটনা, রাজনৈতিক আন্দোলন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা জরুরি সংবাদ এসবের জন্য রাতের অন্ধকারে বা ভোরের অকাল ঘুম ভেঙে, তীব্র চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়। কখনো কখনো এই চাপের ফলে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ঝুঁকি ও বিপদের মুখোমুখি: সাংবাদিকরা প্রায়শই এমন জায়গায় যেতে বাধ্য হন, যেখানে সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে থাকেন। যুদ্ধক্ষেত্র, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, অস্থির রাজনৈতিক এলাকা, অগ্নিকাণ্ড, সুনামি বা বন্যা, এসবের মধ্যে সাংবাদিকরা খবর সংগ্রহ করেন। এই ঝুঁকি শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও বিপজ্জনক। অনেক সময় তারা বিপদে পড়েন, আহত হন বা প্রানহানির ঝুঁকি নিয়েও কাজ চালিয়ে যান।
তথ্য যাচাই ও সততা: একজন সাংবাদিকের কাজ শুধু খবর দেওয়া নয়, সত্য যাচাই করা সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। একটি ভুল খবর শুধু পেশাগত ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর নয়, সমাজে বিভ্রান্তি ও অন্যায়ের সুযোগও তৈরি করতে পারে। তাই সাংবাদিকরা সবসময় সতর্ক থাকেন, যাচাই করেন, উৎস গোপন রাখেন এবং কখনো কখনো নিজের স্বার্থের বিপরীতেও সত্য প্রকাশ করেন।
প্রতিদিনের মানসিক চাপ: দৈনন্দিন কাজের মধ্যে সাংবাদিকদের মানসিক চাপ খুবই সাধারণ বিষয়। কেউ কেউ পরিবারের কথা ভেবে চিন্তিত থাকেন, আবার কেউ সমাজের জন্য দায়িত্ব অনুভব করে নিজেকে চাপের মধ্যে রাখেন। কিন্তু এই মানসিক চাপ সাধারণ মানুষের চোখে আসে না। সংবাদ যখন আমাদের চোখে পড়ে, তখন আমরা ভাবি শুধু তথ্যের পরিমাণ, কিন্তু এর পেছনের সংগ্রাম বুঝতে পারিনা।
অপেক্ষা ও ত্যাগের জীবন: সাংবাদিকদের জীবন কখনোই সহজ নয়। তারা প্রায়শই পরিবার থেকে দূরে থাকেন, সামাজিক জীবন সীমিত থাকে, আর্থিক নিরাপত্তা কম। কিন্তু এই সমস্ত ত্যাগ সত্ত্বেও তারা সত্য প্রকাশে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকেন। ফলে, দৈনন্দিন সংগ্রামে সাংবাদিকরা দৃঢ় মনোবল, ধৈর্য এবং সততার অনন্য মিশ্রণ প্রদর্শন করেন। তাদের দুঃখ-কষ্ট চোখে ধরা না দিলেও, প্রতিটি খবরের পেছনে লুকানো থাকে তাদের নিঃশব্দ সংগ্রাম।